সাত সকালে যখন কাজের প্রস্তুতি নেয়ার সময়, ঠিক তখনই মালতি দৌড়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে। এমন নয় এটাই প্রথম, প্রায়ই এমন করে। কাজের প্রতি এত ভয়! ওর আর দোষ কি কতটুকুই বা বাড়লো! আঙ্গুলের কড়েয় গুনতে বড় জোর তিনটা আঙ্গুল হলেই হয়ে যায়। তবুও সময় বড় বেয়ারা। সকাল পেরুলে পেটে ভাটার টান ঠিকই ভয়ের ভান্ডারে চিড় ধরায়। মন, প্রেম, চাওয়া, পাওয়া সবই স্থিতু হয় পেটের খিদের কাছে। আসলেই কি সব স্থির হয়? সব কিছু?
আট ফুট বাই দশ ফুটের ছোট্ট টিনের ঘর, পরিপাটি করে সাজানো, মেয়েদের ঘর যেমন থাকে তেমনই। একটা সিঙ্গেল খাট, ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল আর সেকেলে একটা আলনা। টিনের বেড়ায় যেখানটায় চারফুটের টিউব লাইটটা সারাটা দিন জ্বলতে থাকে সেখানটায় ঝোলানো ঐশ্বরিয়া রায়ের বেশ আবেদন জাগানো একটা ছবি। লাইটের উজ্জল আলোয় ছবিটার আবেদন আরো বেড়ে যায়। ঘরটায় একটা মাত্র দরজা। কোন জানালাই নেই, এমনকি টিনের বেড়ায় কোন ফুটো দিয়েও আলো আসার জো নেই। আর আসবেই কোত্থেকে পাশাপাশি এবং বিপরীতেও এমন সারি সারি কামড়া করে ভাড়া দিয়েছেন বাড়িওয়ালা। তবুও রক্ষে একটা পাখা মাথার উপর ঘুরতে থাকে সবসময়। এখানকার সবগুলো ঘরই এমন। চারদিক নিরেট, নিষপ্রাণ...। ঘরটার ভাড়াও নেহায়েত কম বলা যাবে না বরং বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। এইটুকু একটা ঘরের ভাড়া মাসে তিন হাজার টাকা।
অনামিকাও নিয়মিত কাজ করে না। তার উপর মালতির কারনেই আরো অনেকগুলো দিন কামাই হয়ে যায়। মালতি দৌড়ে ওর ঘরে এসে যেদিন ঘরে খিল দিয়ে বসবে সেদিন অনামিকার আর নড়বার জো নেই। সহকর্মীরা ডাকতে এসে দরজা ভেঙ্গে ফেললেও সেদিন আর দরজা খোলে না। অনামিকার আয়ের পুরোটাই খরচ হয় নিজের পিছনে আর এই বেয়ারা মেয়েটির জন্য। হবে না! দুটো মানুষের ঘর ভাড়া, খাওয়ার প্রায় পুরোটাই চলে যায় অনামিকার উপর দিয়ে। আয়ের খাতায় কিছুই জমা হয় না।
সেই... কবে সবাইকে ছেড়ে এসেছে ও। এত সময়ে কারো জন্য কিছু করা হয়নি। বাবার শরীরটা প্রায়ই ভালো যায় না। চাকুরী ছাড়ার পর শ্বাসের টানটা আরো বেড়েছে। মা-টাও মরে গেল ছুটকিটার জন্মের দুবছরের মাথায়। সেই থেকেই ওর বাবার মা হয়ে গেছে অনামিকা। "বাবা তুমি কেন সিগারেট খাও? ওটা খেলে তোমার কষ্ট বাড়ে, তুমিতো ছেলে মানুষ নও"। প্রথম প্রথম বাবা এসে ওর ছোট বোনটার মুখের উপর হা করে বলতো "দেখগো বেটি আমার মুখে কোন গন্ধ নেই, আজ সারাদিনেও সিগারেট মুখে তুলিনি, তোর বোনকে বলে দিস..."। বাবার অনভ্যস্ত মুখে পানের দাগ দেখলে অনামিকাকে আর বুঝিয়ে দেয়া লাগতো না সিগারেটের গন্ধ লুকোতে আজ ওর বাবাকে পান চিবিয়ে আসতে হয়েছে। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে একটুকরো হাসি ছড়িয়ে থাকে, সারাটা দিন ওর চিকন ঠোট দুটোতে লাবণ্য ভর করে থাকে।
ঘরে খিল দিয়ে অনামিকার কোলে মাথা রেখে মালতি আবদার করবে গল্প করতে, অনামিকার জীবনের গল্প। অনামিকা খাটের নিচ থেকে কেরোসিনের স্টোভ টেনে নেয়। বালিশের নিচে রাখা দিয়াশলাইটার কাঠি বের করে আগুন জ্বালায় স্টোভে। প্লাস্টিকের ডিব্বা থেকে দুমুঠো চাল হাড়িতে ধুয়ে নিয়ে সে চুলোয় চাপায়, তাতেই দুটো ডিম ধুয়ে ছেড়ে দেয়। আজ দুজনের খাবার আইটেম ভাত আর ডিমের ভর্তা। একাকী জীবনে এই এক-আধ পদের কিছু একটা হলেই চলে যায়। আর ঘরের কাছে কিই বা পাওয়া যায়! কেরোসিনের নরম উত্তাপে ভাত রান্না হতে থাকে। অনামিকা মালতির মাথা কোলে নিয়ে চুলে বিলি কাটে। ওর বয়সী একটা বোন আছে অনামিকার। তাই এত প্রশ্রয় পায় মেয়েটা।
"বুবু বলনা সেই গল্পটা" সেই একই আবদার মালতির। মালতির মাথায় বিলি কাটতে কাটতে আনমনা হয়ে যায় অনামিকা। ঘোর লাগা চোখের দৃষ্টি চলে যায় শত মাইল দূরে...
এইচ.এস.সি. প্রথম বর্ষে যেদিন নবীন বরণ হলো, সেদিন থেকেই ওর সাদামাটা জীবনটা রংয়ে ভরে গেল। গার্লস্ কলেজের পাশে সুন্দর সাজানো একটা স্টুডিও। নবীন বরণের ছবি তুলতে সেখান থেকে যে ছেলেটা এসেছে বয়স বড় জোর পঁচিশ হবে, দেখতে একেবারে রাজপুত্রের মতো। একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। ওকে দেখেই অনামিকার ভাল লেগে যায়। পুরো কলেজ জুড়ে মেয়েরা, কিছু বলতেও পারে না। আর মেয়েগুলোও কেমন, যেন সবাই দৃষ্টি দিয়েই খেয়ে ফেলবে ছেলেটাকে। সেদিন আর ক্লাশ হয়নি। বাহারী কাপড় পড়া মেয়েগুলো সবাই একসাথে বরণ অনুষ্ঠান শেষে যখন গেট দিয়ে বেরুলো মনে হলো যেন এক ঝাঁক পরী নেমে এসেছে ধরায়।
অনামিকার গায়ের চামড়া খুব ফর্সা না তবুও আটোসাটো স্যালোয়ার কামিজে ওকে কেউ দেখলে চোখ সরাতে পারে না। একে একে সবাই কলেজ থেকে চলে গেলে পরে অনামিকা সেই স্টুডিওতে যায়। কোন কাজ নেই তবু যাওয়া। ছেলেটাকে পায় ও, আমতা আমতা করে এক সময় কোন কথা খুজে না পেয়ে ওর ছবি তুলে দিতে বলে। স্টুডিওর ভেতরের ঘরটায় দেয়ালে খুব সুন্দর সুন্দর দৃশ্য আঁকা। ওর পছন্দ হয় না একটাও, তবু একটা বেশ পছন্দ হয়েছে ভাব করে সেখানটায় সোফায় বসে, একেবারে সাধারণ ভাবে বসে। ছেলেটা হাসে, হাসে অনামিকাও "না হেসে কিভাবে বসব দেখিয়ে দিন না" ছেলেটা দেখিয়ে দেয়, চুল ঠিক করে দেয়, ওড়নাটা একটু টেনে গলার কাছে নিয়ে, থুতনিটা একটু এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে, গালে পড়ে থাকা চুল সযতনে ফু দিয়ে সরিয়ে, অনামিকার হৃদয়ে শরীরে একটা ঝড় তুলে দিয়ে ছবি তোলা শেষ হয়।
সপ্তাহ খানেক পরে ছবি পাওয়া যাবে। তবে অনামিকা আর দিন গোনে না। প্রতিদিন ওর বাড়ি থেকে কলেজের রাস্তাটা স্টুডিও হয়ে যেতে থাকলো। এক সময় পাশাপাশি, তারপর আঙুল ছুয়ে কখনো ছৈ নৌকায়, কখনো সবুজ গালিচা বিছানো নদীর ধার ধরে ওদের হেটে যেতে দেখা যায়। আবার মাঝে সাঝে দুজন মিলে নরম ধানের বীজতলায় শুয়ে আকাশ দেখার গল্পও আছে। অফুরন্ত সময়গুলো ভাগ করে নেয় অনামিকা। কখনো গুনগুনিয়ে বাংলা সিনেমায় গত দিনে শুনে আসা গান গাওয়া অথবা বাগান করার পুরনো শখেরা হাতে তুলে দেয় হাসনা হেনার দুটো ডাল... খুন্তি...নিড়ানী...
এটুকু গল্প বলার পর অনামিকার গল্প আর বড় হয় না। মালতিও দিনের পর দিন এই এতটুকুই শুনে আসছে। কখনো মালতি ঘুমিয়ে গেছে, আবার কখনো অনামিকার জলসিক্ত কপোল ছুয়ে যখন গরম নোনা জল ওর মুখে পড়েছে তখন নিজ থেকেই চলে এসেছে নিজের ঘরে। তবু যে করেই হোক অনামিকার গল্প পুরোটা পড়া হয় না মালতির।
দীঘল কালো রাতের আধার যখন চারপাশ দখল করে নেয় সেই সময়টা একান্তই অনামিকার নিজস্ব। সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে সে কখনো হাসনাহেনার দুটো চারা লাগায়, সেগুলোর যত্ন করে অথবা ফেলে আসা সময়ে ঘোরাঘুরি করে খানিকটা। আশ্চর্য! যখন যেখানেই লাগানো হোকনা একটু পানি আর রোদ পেলে গাছগুলো কেমন তরতর করে বেড়ে ওঠে। খলখলিয়ে হেসে ওঠে কখনো সখনো। আবার যখন সে গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়, সি্নগ্ধ মায়াবী ঘ্রাণে ও চোখ বন্ধ করে নেয়। তখন হয়তো কোন স্টুডিওর একটা ছেলে ওকে কাঁদিয়ে যায়, অথবা ও ভাবে ওর শ্বাসের রোগী বাবাটাকে, অবুঝ ছোট বোনটাকে। তবে আজ দিনের আলোতে যখন ওর আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে তখন রাতের একাকীত্বের অধিকারটুকুও সে খাটাতে পারে না। আনমনে গল্প করতে করতে ও কেঁদে বুক ভাসিয়েছে...
মালতি ছাড়া কখনো তাকে কাঁদতে দেখেনি কেউ। লেখাপড়া জানে বলে ওর অন্যরকম একটা টান আছে সবার কাছে। প্রায় সবাই বিপদে ওর সাহায্য নেয়, সবাই ভাবে অনামিকা খুব কঠিন হৃদয়া। প্রসঙ্গ পাল্টাতে আজ মালতির এভাবে দৌড়ে আসার কারন জানতে চায় অনামিকা। মালতি অবাক হয়। খিল খিল করে হেসে যে কথা ও অনামিকাকে বলে- সে কথা শুনে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার কথা। "বাদ দাও বুবু ও প্যাচাল, আজ শুধু তোমার কথা বল"...
আজ বলবে, অনামিকা সব কিছু বলবে আজ। "জানিস মালতি আমরা সেদিন অ...নে...ক... দূ... রে... চলে গিয়েছিলাম"। এক হাতে সেই ছেলেটার হাত ধরে আর এক হাতে জুতো জোড়া তুলে নিয়ে নদীর খাড়ি বেয়ে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে হেটে যাওয়ার গল্প করে অনামিকা। সে যত দূরে গিয়েছিল সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। শুধু সামনে যেতে হয়। লোকালয় ছেড়ে যখন ওরা সবুজ খোলা প্রান্তরে পৌছায় ততক্ষণে জোনাক পোকাগুলো ওদের ঘিরে আলোর বাসর সাজায়। স্বর্গ বাসরে দুজন হারিয়ে যায় দূরে কোথাও। ওদের স্বর্গসুখের সে গল্প আমাদের জানানোর জন্য তখন সেখানে কেউ ছিল না। সেটুকু জানে কেবল অনামিকা, খোলা আকাশ আর সবুজ গালিচা। অসহ্য সুন্দর সুখে ভেসে যখন বলল "চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি" অনামিকার সে কথায় ছেলেটা ভড়কে যায়নি। অনামিকার মুখটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে চেপে ধরেছিল বুকের প্রশস্ত জায়গাটায়। অনামিকাও ছিল নিশ্চিন্ত, নির্ভার। ছেলেটা শুধু বলেছিল "চলো আমরা অনেক দূরে চলে যাই, সেখানে আমরা স্বর্গ গড়বো" অনামিকা মাদকচোখে সে স্বর্গ দেখেছিল, তাই চলে এসেছিল তার হাত ধরে। তারপর... প্রতিদিন স্বর্গ বাসর হয় অনামিকার। টিনের খুপড়ি ঘরে ওর নিজের স্বর্গ, একান্তই নিজের।
"জানো বুবু তোমার জন্য আমার প্রাণটা কেমন করে ওঠে! তোমার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি" গল্পে ছেদ ঘটায় মালতি। "সত্যিই সব করতে পারবি"? "হ্যা পারব" দৌলতদিয়ার চার দেয়ালে বন্দি পতিতা পল্লীর ঘুপচি ঘরে বারো বছর বয়সী মালতির কন্ঠে দীপ্ত আওয়াজ আসে, কন্ঠস্বর জোড়ালো হয় "তুমি বলেই দেখো বুবু তোমার জন্য মরতেও পারি"।
অনামিকার দৃষ্টি বন্ধ দরজা ভেদ করে অনেক অনেক দূরে হারিয়ে যায়... "অনেকদিন খোলা মাঠে হাটি নারে, কতদিন হাসনাহেনার ঘ্রাণ পাই না, শিশির ঢাকা ঘাসে হাটি না বহুদিন... পারবি আমার জন্য একটুকরো সবুজ এনে দিতে? প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিতাম"।
মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরতে থাকে অবিরাম, সে হাওয়ায় সবুজ প্রান্তরের মুক্ত বাতাসের স্বাদ অথবা অনেক দূরে... নিজ বাড়িতে নিজের হাতে লাগানো হাসনা হেনার ঘ্রাণ ওরা পেয়েছিল কিনা কেউ কখনো জানতে পারেনি...
২৯ জানুয়ারী - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪